সেগুনকাঠের নকশা-খাট

সেগুনকাঠের নকশা-খাট

অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলো অরণ্য। বেশ রাত হয়েছে, খেতেও ইচ্ছে করছে না। একটু ঘুম দরকার। ব্যাগটা কোনোমতে একপাশে ছুঁড়ে দিয়ে  পোশাক না বদলেই বিছানায় শুয়ে পড়লো অরণ্য, যেন হাজার বছরের ঘুম এসে বাসা বেঁধেছে ওর চোখে। ঠিক কতসময় তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলো খেয়াল করেনি, রিনঠিন একটা শব্দে আধোঘুম মেখে চোখ মেলে তাকালো। হালকা মিষ্টি সুগন্ধ ছড়িয়ে আছে ঘরে, আলোআঁধারিতে একটা নরম স্পর্শ অনুভব করলো অরণ্য তার মাথায়, কেউ যেন পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়, তারই হাতের চুড়ির রিনঠিন শব্দ উঠছে ধীরে ধীরে। আধোঘুম জড়ানো গলায় অরণ্য বলে উঠলো — ‘উর্ণা, কোথায় গিয়েছিলে তুমি?’ নারী মূর্তিটি মৃদু হাসলো। বড় মিষ্টি সে হাসি। হঠাৎ তীক্ষ্ণ আওয়াজে অরণ্যর সেলফোন বেজে উঠতেই অরণ্য ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। কোথায় কে! ঘরে কেউ নেই, অফিসের পোশাকটাও বদলায়নি সে, ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘড়ি দেখলো, রাত ২টো। ফোনটা তখনো বেজে চলেছে।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো রিমা কল্ করেছে। রিসিভ্ করার আগেই সেটা কেটে গেলো। ঘেমে ভিজে উঠেছে অরণ্য, ঘুমের মধ্যে কে ছিলো ওর পাশে! কাকে দেখলো অরণ্য? উর্ণা? তবে কী? … অরণ্যর দমবন্ধ হতে শুরু করলো। উঠে ঘরের সব আলো জ্বেলে দিলো সে। ভালো করে একবার খাটের দিকে তাকালো অরণ্য- সেগুন কাঠের এই নকশা করা খাটখানা বড় প্রিয় ছিলো উর্ণার। সে সবসময় বলতো— ‘এই খাট ছেড়ে আমি থাকতেই পারি না, এখানেই থাকবো আমি মরে গেলেও…’ বলে খিলখিলিয়ে হাসতো।

 

রিমার সাথে অরণ্যর আলাপ হয়েছে প্রায় তিনমাস। রিমা অরণ্যকে বিয়ে করতে চায় না কিন্তু ইউজ করে ভালোবাসা পেতে চায়, পেতে চায় ওকে। অরণ্যর ফিনান্সিয়াল দিকটা বেশ ভালো এটা রিমা পরখ করেই নিয়েছে, শুনেছে অরণ্যর দীর্ঘদিনের প্রেমিকা যে তার স্ত্রী ও ছিলো, তার মৃত্যু হয়েছে প্রায় এক বছর হতে চললো। অরণ্য সারাদিন কাজ করে ঠিকই কিন্তু মুষড়ে থাকে কেমন‌ যেন। রিমা এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে চায়, অরণ্যর দুর্বল জায়গার সুযোগ নিয়েই সে কবজা করতে চায় অরণ্যকে। অরণ্য কয়েকবার কথাও বলেছে রিমার সাথে। রিমা অরণ্যর অফিসেই কাজ করে রিসেপশনে,কাজেই অরণ্যর ব্যাপারে কিছু কিছু জানেও সে। এমন হ্যান্ডসাম ছেলের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে রিমা পারদর্শী। কাজেই রিমা ভাব জমাতে শুরু করে অরণ্যর সাথে। বেশ কয়েকবার অরণ্যর বাড়ি যেতেও চেষ্টা করেছে রিমা কিন্তু অরণ্য সায় দেয়নি। রিমারও জেদ চেপে গেছে সে যাবেই।

 

আজকাল অরণ্য কেমন দিশেহারা থাকে, উস্কোখুস্কো চুল, শুকনো চেহারা, আগের সেই গ্ল্যামারটাও কমেছে একটু। কীসের এক ভয়ানক অভাব তার চোখে। রাতেই সে ঘরে ফেরে, শূন্য ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না তার, তবু কী এক অপরাধবোধে ধরা দেয় সে। সারা ঘরে শুধু উর্ণার স্মৃতি, কেন এভাবে চলে গেলো উর্ণা, আরেকটু কি সে বোঝাতে পারতো না অরণ্যকে! আরো ভালোবেসে বললে কি অরণ্য বদলাতো না নিজেকে? এসব ভাবনার মধ্যেই অরণ্য ফোনটা আবার বেজে ওঠে, রিমা আবার কল করেছে। কী চায় মেয়েটা! অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোন রিসিভ করে অরণ্য। প্রেমালাপ জমাতেই এই ফোন, অরণ্য বলে— ‘কাল এসো, কথা হবে। এখন আই অ্যাম জাস্ট ট্রাইং টু স্লিপ, প্লিজ রিমা কল কোরো না।’ বলেই কেটে দিলো অরণ্য। ফোনটা অফ করে দিয়ে জোর করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো অরণ্য।

 

রিমা আজ যাবেই অরণ্যর সাথে, অফিস শেষে সে অরণ্যর গাড়িতেই উঠে পড়লো। অরণ্য আজ আবার ড্রিঙ্ক করেছে, হালকা নেশাও হয়েছে। তাই রিমা কে বাধাও দিলো‌ না। রিমা তো এই সুযোগের জন্যেই অপেক্ষা করছিলো। বাড়িতে এসে অরণ্য রিমা কে নিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে এলো, ওর মায়ের কোনো কথার জবাব দিলো না। বন্ধ ঘরে যেন দমকা বাতাস খেলে গেলো। রিমা প্রথমটায় একটু ভয় পেয়ে গেছিলো, অরণ্য হাসলো। রিমা একটু বোল্ড সেজেছে, আজ সে অরণ্যকে পাগল করে দেবেই। অরণ্য ওয়াশরুমে ঢুকতেই রিমা খাটে এসে বসলো। মাথার দিকের দেওয়ালে উর্ণার সহাস্য একটা ফটো ঝুলছে, মিষ্টি মুখটা। রিমা ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল—’দেখো বোকা মেয়ে, তোমার অরণ্য আজ থেকে আমার হবে। ভাগ্যিস তুই আগেই মরেছিস, তাই তো আমি এলাম। তোর কোনো অস্তিত্ব আমি অরণ্যর লাইফে রাখবোই না।’ বলে আপন মনে হাসতে থাকলো রিমা, হাসতে হাসতে গা এলিয়ে দিলো খাটের ওপর। হঠাৎ যেন মনে হলো খাটের দুপাশ রিমাকে চেপে ধরেছে, রিমা কিছুতেই উঠতে পারছে না, রিমাকে যেন চেপে ধরে পিষে ফেলতে চাইছে বিছানাটা। রিমা অরণ্যকে ডাকতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না, গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না তার। এর মধ্যেই অরণ্য ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে, দেখলো রিমা বিছানায় বসে আছে, ঘামে ভিজে উঠেছে, দুচোখে আতঙ্ক। অরণ্য আসতেই রিমা বলল— ‘অরণ্য, এই ঘরে কী আছে, আমি তো, আমি তো…’ তাকে থামিয়ে অরণ্য বলল ‘কোথাও কিছু নেই ডার্লিং, তুমি আরাম করে বোসো, আমি একটু খানাপিনার ব্যবস্থা করি আমাদের!’ বলে হেসে অরণ্য এক বোতল ওয়াইন, আর নানারকম চিপস্ পাকোড়া ব্যাগ থেকে বার করে সাজিয়ে দিলো। রিমা এতক্ষণে সহজ হতে পেরেছে, একটা গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে অরণ্য গায়ে ঢলে পড়লো, দুজনে দুজনকে জড়িয়ে উঠে এসে পড়লো বিছানায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে অর্ধনগ্ন দুটো মানুষ খাট থেকে ছিটকে পড়লো দু’দিকে। রিমার কাপাল কেটে গেল ভাঙা কাচের গ্লাসে। অরণ্যর মাথাতেও সামান্য চোট লেগেছে। ওরা দুজনেই স্তম্ভিত। এটা কী করে সম্ভব! বিছানা টা দুজনকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো! আশ্চর্য! অরণ্যর এতক্ষণে নেশা ছুটে গেছে, হঠাৎ চোখ গেল উর্ণার ছবির ওপর, অরণ্য দু হাতে মুখ ঢেকে মেঝেতে বসে পড়লো। রিমা কী করবে ভেবে না পেয়ে ছুটে বেরিয়ে গলো অরণ্যর ঘর থেকে। অরণ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। অরণ্য আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল, আর বললো— ‘আমায় ক্ষমা করে দাও উর্ণা, একবার ফিরে এসো, আমার একবার শুধরানোর সুযোগ দাও।’ এভাবে কখন ঘুমিয়ে পড়লো অরণ্য, ঘুম ভাঙলো সকাল আটটায়। ফ্রেশ হয়ে, রেডি হয়ে অরণ্য জুতোটা পরছে এমন সময় ওর ঘরে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো রিমা। কপালের ডান দিকে ব্যান্ডেট লাগানো। অরণ্য বললো—’কালকের জন্য সরি রিমা, আসলে আমি বুঝতে পারিনি..’ ওকে থামিয়ে দিয়ে ওর পাশে বসে একটা হাত ধরে রিমা বললো—’প্লিজ অরণ্য, ওসব বোলো না, আমি কিচ্ছু মনে করিনি। শুধু কষ্ট হয়েছে তোমাকে পেয়েও পাইনি কাল। আজ প্লিজ ছুটি নিয়ে নাও। আমরা কোথাও একটা ঘুরে আসি।’ অরণ্য বললো—’ছুটি নেওয়া ইম্পসিবল রিমা। অফিসের পর দেখা করছি। তুমি এসো।’ অরণ্য রিমাকে অ্যাভয়েড করতে চাইছে, কিন্তু যে ভুল সে গতরাতে করে ফেলেছে তারপর রিমা আরো ডেসপারেট হয়ে উঠেছে। কিছুতেই তাকে কাটিয়ে উঠতে পারছে না অরণ্য। শেষে বাধ্য হয়েই মেলামেশা করছে, আর রিমা তো এটাই চেয়েছিলো। অরণ্য নিজের ঘরে বারবার রিমা কে নিয়ে ঘনিষ্ঠ ভাবে থাকার চেষ্টা করেছে আর বারবারই এমন অলৌকিক কিছু ঘটেছে যে ওরা বুঝে গেছে ওই বিছানাতেই কিছু আছে, ওটাকে সরানোর চেষ্টা করেও পারেনি। একদিন রিমা অরণ্যকে ফাঁসাতে চেয়ে ওর ডিঙ্ক গ্লাসে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলো, যাতে অরণ্যর সবটুকু ও কবজা করতে পারে। কিন্তু সেদিন ঘটলো এক ভয়ানক ঘটনা। অর্ধেক অচেতন অরণ্যকে রিমা যখন নিজের জালে ফাঁসাতে চাইছে ঠিক সেইসময় সিলিং ফ্যানটা খুলে এসে পড়লো রিমার মাথায়। গভীর ক্ষতে রক্তাক্ত হয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইলো রিমা।

 

এরপর কেটে গেছে কয়েকমাস, রিমা মরার মতো বেঁচে আছে, একপ্রকার কোমা বলা যায়। আর অরণ্য বাইরে বাইরে থাকে, রিমার পর আরো কয়েকটা মেয়ে এসেছে অরণ্যর জীবনে, কিন্তু কিছুদিনের জন্যেই, অরণ্য যেন এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে…রোজ রাতে বিছানায় এসে বিড়বিড় করে অরণ্য, আর ফিরে যায় স্মৃতিচারণায়, নিজের কপাল চাপড়ায়…

 

বড্ড সুন্দর চোখ ধাঁধানো আসবাবপত্র দিয়েছিলেন উর্ণার বাবা ওর বিয়েতে। যদিও প্রথম দিকে উর্ণার প্রেম মেনে নিতে চাননি মহেন্দ্রবাবু। দুটি ছেলের পর একটিমাত্র আদুরে মেয়ে, বড় শান্তস্বভাবা, কোনোদিন কোনো অবাধ্যতা সে করেনি, লেখাপড়া ছাড়া তার জীবনে আর কিছুই ছিলো না। মাস্টারস্ করার সময় অরণ্যর সাথে আলাপ হয় উর্ণার। ধীরে ধীরে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসার সূত্রপাত। অরণ্য পরিবারের দায়িত্ব বড় ছোটো বয়সে নেওয়ায় বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেনি, তবে ব্রিলিয়ান্ট ছিলো সাথে থিয়েটারের শখটাও ছিলো মারাত্মক। একসময় থিয়েটারের সাথে যুক্ত ছিলো বটে কিন্তু পরিস্থিতি তাকে তার মনমতো রাস্তায় হাঁটতে দেয়নি। তারপর যে কাজ করেছে সেখানেই উন্নতি করেছে, ভীষণ ভালো বাচনভঙ্গি অরণ্যকে আরো সাফল্য এনে দিয়েছে তার উন্নতির পথে।

 

 বেশ কয়েকবছর প্রেমের পর অরণ্য আর উর্ণার বিয়েটা ফাইনাল হয়েই গেলো। উর্ণার বাবাও শেষপর্যন্ত আর অমত করেননি। আসলে অরণ্যকে দেখে আর ওর সাথে কথা বলে বেশ ভালো লেগেছিলো মহেন্দ্রবাবুর। সমাজে ভীষণ হাই-ফাই স্ট্যাটাস না হলেও অরণ্য ভালো বংশের ছেলে, ওর বাবা বড় ভালো মানুষ, গম্ভীর অথচ সহৃদয়, অত্যন্ত নম্র অথচ দাপুটে। তবে বর্তমানে বড় অসুস্থ। অরণ্য বাবা-মায়ের একটিই সন্তান। তার বাবার অসুস্থতা প্রায় তার শৈশব থেকেই। কাজেই অনেক স্বপ্ন থাকলেও অরণ্য পরিস্থিতির চাপে কিছুই করতে পারেনি যা সে চেয়েছে। তবু সে থেমে থাকেনি। ডাকসাইটে হয়ে সব জায়গায় নিজের একটা পোক্ত জায়গা সে করে নিয়েছে।

 

আজ প্রায় চারবছর প্রেমের পর উর্ণা আর অরণ্য এক সুতোয় বাঁধা পড়তে চলেছে। বিয়েটা সুষ্ঠুভাবে হলোও। উর্ণার বাবা মনমতো সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছে একমাত্র আদুরে মেয়েকে। যদিও অরণ্যর কোনো চাহিদা ছিলো না, বরং ও কিছুই নিতে চায়নি এসব, তবু, মেয়ের বাবা তো, মেয়ের কথা ভাববেন তা স্বাভাবিক। বিয়ের উপহারের মধ্যে উর্ণার সবচেয়ে পছন্দ তার খাট। সেগুনকাঠের সুন্দর নকশা করা খাট। উর্ণা বাবার সাথে গিয়ে পছন্দ করেছে খাটখানা। বড্ড প্রিয় বস্তু ওটা। সাথে আরো আসবাব গয়না অনেক আছে কিন্তু তারমধ্যেও খাটখানায় যেন উর্ণার প্রাণভোমরা। অরণ্যকেও সে বলেছে— ‘দ্যাখো, কোনোরকম বদমায়েশি আর ঝগড়া যদি করো আমার সাথে, একদম আমার খাটে উঠবে না তুমি। আমি তোমাকে ঘুমোতে দেবো না এই খাটে, এই বলে রাখলাম।”

 

উর্ণার কথা শুনে অরণ্য শুধু হেসেছে। এভাবেই খুনসুঁটি তে দু/চারদিন কাটলো ওদের নতুন জীবনের। উর্ণা সারাদিন একা এই বাড়িতে, অরণ্য সকালে কাজে বেরোয় আর ফেরে সেই রাতে। বড্ড একা লাগে ওর, কথা বলার ও কেউ নেই। শাশুড়ির সাথে কথা বলতে চাইলেও সে আলাদা ধরণের আলাদা জগতের মানুষ। বারবারই উর্ণা আঘাত পেয়েছে তাই সে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা হয় না, বলতে ইচ্ছেও করে না উর্ণার। কারণ বৌভাতের পরদিন থেকেই উর্ণাকে নানান খোঁটা নানান কথা শুনতে হয়েছে। কষ্ট পেলেও উর্ণা মুখ ফুটে একটা শব্দও বলেনি। অরণ্যকে বলতে চাইলে সেও ভুল বুঝেছে। উর্ণা বড় শান্ত মেয়ে, উচ্চ শিক্ষিতা, পড়তে আর লিখতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে ও। তাছাড়া এর বাইরে কোনোদিন কিছু নিয়েই মাথা ঘামায়নি। কিন্তু বিয়ের পর যেন জীবন বদলে গেলো। যেখানে অনেক স্বপ্ন নিয়ে এলো সেখানে কোনো মান নেই, ভালোবাসার মানুষটাও কেমন চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে — এইভাবে দমবন্ধ হয়ে থাকতে না পেরে উর্ণা বাবা মায়ের কাছে চলে গিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচতো। কিন্তু তাতে আরো বেশি ভুল বোঝাবুঝি আরো অশান্তি সৃষ্টি হলো। চিরচেনা অরণ্যকে উর্ণার সম্পূর্ণ অচেনা মনে হলো।

এমনি করেই চোখের জল ফেলে উর্ণার দিন যায়, রাত যায়। যে প্রকৃতির কাছে না গিয়ে উর্ণা শান্তি পেতো না, সেই প্রকৃতির থেকে নিজেকে সরিয়ে ঘরবন্দী করে রাখলো সে; পড়ার মধ্যেও মন বসাতে পারলো না, লিখতে পারলো না দু-লাইন। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে উর্ণার। তবু আবার সেই অরণ্যর বাড়িতেই ফিরলো উর্ণা। কারণ বিয়ের পর মেয়েদের কোনো বাড়ি থাকে না। বাস্তবটাই তাই। ঘরে এসে নিজের প্রিয় খাটে শুয়ে অঝোরে কেঁদে চলে উর্ণা। — সে কী করলো! কেন করলো! কেন ভালোবাসলো অরণ্যকে! কী করবে এখন কোথায় যাবে! জীবনে কতকিছু করতে চেয়েছিলো মেয়েটা, বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলো। কত স্বপ্ন দেখেছিলো। অথচ আজ, ঘরবন্দী হয়ে কাঁদতে হচ্ছে তাও লুকিয়ে। অরণ্য রাত করে ফেরে, ড্রিঙ্ক করে আসে। উর্ণার দমবন্ধ হয়ে আসে ওর পাশে শুয়ে থাকতে। তবু কিছু বলে না। একদিন প্রচণ্ড ঝামেলা অশান্তি হয় সারারাত ধরে। অরণ্য নেশার ঘোরে উর্ণার গায়ে হাত তোলে, ঘরে ভাঙচুর করে- তারপর ঘুমিয়ে পড়ে একসময়। উর্ণা হতবাক হয়ে শুধু নিজেকে দেখে। নিজের ওপর করুণা হয় ওর। ক্লান্ত হয়ে অভ্যাসবশত প্রিয় খাটে শুয়ে পড়ে, ঘুম আসে না। পাশে অরণ্য অসাড়ে ঘুমোচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। পরদিন ঘুম ভাঙে বেলা এগারোটায়। অরণ্য নিজেও অবাক হয় ঘরের অবস্থা দেখে, উর্ণা হাঁটুর ওপর মাথা রেখে বসে আছে দেখে। অরণ্য ধড়ফড় করে উঠে উর্ণার পিঠে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করে— ‘কী হয়েছে উর্ণা! ঘরের এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে? আমি কি কিছু করেছি?’ উর্ণা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। গতরাতের ঘটনা সবটা বললো। অরণ্যর যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে সে এসব করেছে, তাও উর্ণার সাথে! এও কী সম্ভব! অরণ্য উর্ণাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো, বললো— ‘আমায় ক্ষমা করে দাও উর্ণা, আমি আর কখনো ড্রিঙ্কস করবো‌ না তোমার সামনে। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও।’

উর্ণা জলভরা দুটো চোখে শুধু তাকিয়ে থাকলো অরণ্যর দিকে। কাকে সে ভালোবেসেছে! কার জন্য সবার বিরূদ্ধে গিয়েছে! মাঝে মাঝে উর্ণার নিজের ওপর হাসি পায়, করুণাও হয়। অরণ্য অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পরে উর্ণা শুধু খাটের উপর শুয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো।

 

কিছুদিন পর, উর্ণা আবার চেষ্টা করছে পড়াশোনা করার, নতুন করে বাঁচার। কিন্তু উর্ণার ভাগ্যে বুঝি সুখ নেই। অরণ্য আবার সব ভুলেছে, আবার ড্রিঙ্কস করছে, আর উর্ণাকে এসব মেনে নিতেও ফোর্স করছে, ঘরে বসে উর্ণার সামনে ড্রিঙ্কস করছে অরণ্য। উর্ণা ওকে বোঝাতে পারে না যে ও এসব করলে উর্ণার কত কষ্ট হয়, হৃদয় ফেটে যেন চৌচির হয়ে যায়। তবু মুখে কিছু বলতে পারে না উর্ণা, কারণ অরণ্যকে বারবার সে বুঝিয়েছে; ভালোবেসে বুঝিয়েছে, শাসন করে দেখেছে, উল্টে অরণ্য শুধুই উর্ণাকে ভুল বুঝেছে, অনেক বাজে বাজে কথা বলেছে, আর উর্ণা শুধু লুকিয়ে চোখের জলে ভেসেছে। সারাদিন ঘরের সব কাজ করে উর্ণা, দুপুরে একটু বিশ্রাম করে নিজের খাটে,  বড় তৃপ্তিতে, ঘরটা গোছায়, গুনগুন করে, আসবাব গুলো মোছামুছি করে। যেন জীবনে সবকিছু ঠিক আছে। কিছুই হয়নি। খাটখানাকে বড় যত্ন করে ধুলো মুছে দেয়। দিনদিন যেন আরো মায়া বেড়ে যাচ্ছে খাটটার ওপর। রোজকার জীবন যেমন চলছিলো, চলে। অরণ্য যেন দিনদিন কেমন বদলে যেতে শুরু করে। আজকাল সেভাবে কথাও হয় না ওদের। যান্ত্রিক জীবন যেন ওদের। উর্ণা একেকসময় কাঁদে, পুরোনো কথা ভেবে বড্ড কষ্ট হয় ওর। কীভাবে অরণ্য এতটা পালটে যেতে পারে!

 

উর্ণা একদিন ঘরের সব কাজ করে। অরণ্যকে যত্ন করে রান্না করে খাইয়ে অফিসে পাঠায়, খাটটাকে সযত্নে ধুলো ঝেড়ে দেয়, তারপর ওর বড্ড ঘুম পায়। বিরিয়ানি বেশ পছন্দের খাবার উর্ণার। খিদে পেটে উর্ণা ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট শিশি বার করে, বিরিয়ানি তে মেশায় কী একটা তরল পদার্থ, তারপর খেয়ে নেয় তৃপ্তি করে। হাত মুখ ধুয়ে খাটে শুয়ে পড়ে। অনেক রাতে অরণ্য ফেরে, উর্ণা তখনো ঘুমোয়। হাজার ডাকাডাকিতেও উর্ণার ঘুম আর ভাঙে না। তার প্রিয় সেগুনকাঠের নকশা করা খাটে চিরঘুমে তলিয়ে যায় উর্ণা। সব অশান্তি সব যন্ত্রণা সব ব্যর্থতা থেকে দূরে- পালিয়ে যেন বাঁচে উর্ণা।

 

এ কী! খাটে শুয়ে আছে উর্ণা! এই তো সেই তার প্রিয় সেগুনকাঠের নকশা করা খাটখানা। বিয়ের সময় বাবা দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পরেও উর্ণা খাটটাকে ছাড়তে পারেনি। এত মায়ায় জড়িয়ে গেছে যে খাটের আসক্তি থেকে উদ্ধার পায়নি উর্ণা। কিন্তু অরণ্য কেন এখানে! ‘আর পাশে ও কে? ওহ্! অরণ্য বাবুর নতুন প্রেমিকা বুঝি! আমার খাটে শুয়ে প্রেম করা? যে খাট আমার এত পবিত্র এত সুখস্মৃতি তে ঘেরা, সেই খাটে নষ্টামো! ইতর ছোটোলোক! দেখাচ্ছি মজা দাঁড়া ব্যাটা!” এক দমকা বাতাসে খাট থেকে একজোড়া ছেলেমেয়ে নীচে পড়ে যায়। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ছুটে পালায় ওরা। কেউ যেন খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। 

 

বাইরে বাতাসে কার তৃপ্তিমাখা হাসি আর গুনগুন সুরে গান শোনা যায়। বহুবছর কেটে গেছে, ওই সেগুধকাঠের নকশা করা খাটখানা পুরোনো ঝোপঝাড় ওঠা ভাঙা বাড়িতে পড়ে আছে একদম নতুন হয়ে। আজ আবার ঝোপঝাড় পরিস্কার করা চলছে, কী নাকি শুটিং হবে। খাটখানা হবে মূল ক্যারেক্টার। বাতাসে যেন ঢেউ খেলে যায়, কার গুনগুন সুরের সাথে মিষ্টি হাসি শোনা যায়।

গল্পটি কেমন লাগল? কমেন্টে অবশ্যই জানাবেন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top